সমৃদ্ধ অঞ্চলের গৌরব থেকে দারিদ্র্যের শিখরে বরিশাল
| PNN
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৭:৪৩ অপরাহ্ণ

ধান, নদী, খাল-এই তিনে বরিশাল। শুধু এই তকমাতেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার সমৃদ্ধ অঞ্চলও ছিল এটি। এত বেশি খাল এ বিভাগে, যে কারণে একে বাংলার ভেনিসও বলা হয়। অর্থনীতিতে বরিশালের প্রতিটি পরিবার এত সমৃদ্ধ ছিল যে, এ অঞ্চল থেকেই বাংলার ইতিহাসের বড় নেতারা উঠে এসেছিলেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ অঞ্চল এখন দারিদ্র্যের শিখরে অবস্থান করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিজমিতে লবণাক্ততা, উন্নয়ন বৈষম্য-সব মিলিয়ে দারিদ্র্যের অভিশাপ ঘোচাতে মানুষ ছুটছেন রাজধানীতে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও শিল্প ও অর্থনীতিতে খুব একটা এগোতে পারেনি বরিশাল। গড়ে ওঠেনি কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানকার স্থানীয় অর্থনীতিও দেশের অন্য বড় শহরগুলোর মতো অতটা চাঙ্গা নয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বাড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। কৃষিজমিতে কমছে উৎপাদন। কাজ হারিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ ছুটছেন ঢাকায়। সরকারি হিসাব বলছে, রাজধানীতে বিভিন্ন বিভাগের মানুষের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বরিশাল বিভাগ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এতে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন। ছয় জেলা নিয়ে গঠিত এ বিভাগে দারিদ্র্যের হার এখন ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিভাগটির প্রতি চারজনে একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরে দারিদ্র্যের হার ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা এ বিভাগে সর্বোচ্চ। পিরোজপুর সদরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সদর উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৪৮ জনই দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে শিল্পায়ন হয়নি। ফলে শোভন কর্মসংস্থানও এ অঞ্চলে হয়নি। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য আরো বাড়ছে। রেমিট্যান্সও খুব বেশি আসে না এ বিভাগে। সবগুলো কারণ মিলিয়ে এ অঞ্চলের দারিদ্র্য বেড়েছে।
এ অঞ্চলের বড় সংকট কর্মসংস্থান। গত ২৯ জানুয়ারি অর্থনৈতিক শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। এ প্রতিবেদনে সারাদেশে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে বলে উঠে এসেছে। এরমধ্যে বরিশালে ইউনিটের সংখ্যা মাত্র ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩৬টি। সারাদেশের হিস্যায় বরিশালের মাত্র ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ বিভাগটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শোভন কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য একটি আরেকটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বরিশাল অঞ্চলে যেমন শিল্পায়ন কম হয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগও বেশি হচ্ছে। বরিশালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্পর্শকাতরতা ও জলবায়ুর প্রভাব রয়েছে। শিল্পায়ন কম হয়েছে, এর অর্থ হলো যেসব কর্মসংস্থানে শোভন মজুরি পাওয়া যায়, তা কম হয়েছে। শিল্পায়ন ও উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ভৌগোলিক যে বিভাজন দেখা যায়, এর জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবই জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, বরিশাল অঞ্চল এক ধরনের জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। তা ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন কিছুটা ভালো হয়েছে। শিল্পায়নের জায়গা যতটা সম্ভাবনার হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি ওই অঞ্চলে। যে হারে অন্য অঞ্চলগুলো উন্নয়ন করেছে, সে হারে এ অঞ্চল করতে পারেনি। রেমিট্যান্সের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলেও বরিশাল বিভাগে তেমন একটা কমেনি। সবগুলো কারণ মিলিয়ে এ অঞ্চলে দারিদ্র্য বেড়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বেশি থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পায়ন হলে উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থান হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতায় বরিশালে শিল্পায়নও তেমন হয়নি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ বিভাগের শিল্পায়নে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে সেখানে উদ্যোক্তাদের শিল্পায়নের ইচ্ছা থাকলেও পারছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সমুদ্র নিকটবর্তী হওয়ায় বরিশাল বিভাগের সব জেলা নদ-নদী ও খাল-বিল বেষ্টিত। এ বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা ৯৯টি। নদীপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে ব্যয় সড়ক ও রেলপথের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম থাকায় সে সুযোগটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
কলকারখানা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বরিশাল বিভাগে মোট কলকারখানার সংখ্যা ৮৬৬টি। এর মধ্যে শুধু বরিশাল জেলায় ৩৮৫টি কলকারখানা আছে। জ্বালানি সংকটের কারণে এখানে নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে না।
জানতে চাইলে বিসিক বরিশাল জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম আমার দেশকে জানান, পদ্মা সেতু হওয়ার পূর্বের এবং পরের চিত্রে কিছুটা পার্থক্য আছে। কারণ এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। সাধারণ মানুষেরই যেখানে চলাচল স্বাভাবিক ছিল না, সেখানে শিল্পায়নের বিঘ্ন তো ঘটবেই।
শিল্পায়ন কিছুটা বাড়লেও সংকট ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা আরো বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ায় কিছু ভালো ও নতুন উদ্যোক্তা বরিশালে যোগ হচ্ছেন। তবে এখানে গ্যাসের জটিলতা রয়েছে। যদি ভোলা থেকে গ্যাস পাওয়া যায়, তাহলে এখানে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমানও শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকার একই যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, শিল্পায়নের সঙ্গে অবকাঠামো, মানসম্মত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিষয় সম্পৃক্ত। সেখানে বিসিকে যে শিল্পগুলো আগে করা হয়েছিল, সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। সামনের বাজেটে এ অঞ্চলে নজর দেওয়া দরকার, অর্থায়ন দরকার।
পূর্বে এ অঞ্চল স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকায় এখান থেকে উঠে এসেছেন দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ এবং কবি-সাহিত্যিক। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর রাজনীতিবিদ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, কবি জীবনানন্দ দাশ, কবি সুফিয়া কামাল, রাজনীতিবিদ আবদুর রব সেরনিয়াবত, লেখক ও সাহিত্যিক কামিনী রায়, বামপন্থি সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যক্তি সরদার ফজলুল করিম; সুরকার, সাংস্কৃতিককর্মী ও স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদসহ আরো অনেকে ছিলেন বরিশালের।
ড. মোস্তাফিজুর বলেন, যখন বরিশাল অঞ্চল থেকে বড় বড় নেতা উঠে এসেছিলেন, তখন মাথাপিছু আয় বা যেটুকু উন্নয়ন এখন দেখা যায়, সেটি ছিল না। তখনকার চেয়ে এখন খারাপ হয়েছে তা নয়, বরং তুলনামূলকভাবে বরিশাল পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে দেশের শহরাঞ্চলে যত বস্তি ছিল, সেগুলোর বাসিন্দাদের বেশিরভাগই আসে পাঁচ জেলা থেকে। আর ওই জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বরিশাল। বস্তিগুলোয় বরিশালের পরিবার ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।