৯ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৯ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

রাজনৈতিক সহনশীলতা-সম্প্রীতি বজায় রাখতেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জরুরি


| PNN

৯ মার্চ, ২০২৫, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দাবি করে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় থাকে।

শনিবার (৮ মার্চ) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ১১ বছর পর বিদেশি কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিল জামায়াতে ইসলামী। সেখানে আয়োজকের বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।

রাজধানীর গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপি, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়ো ওয়েন, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার গিরি গোরিওভিস কোজিন, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার সুসান রেলি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মিকায়েল মিলার, ইরানের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রমিস সেন, পাকিস্তানের হাইকমিশনার কামরান ধাংগল, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ভারত, ভুটান, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, ভ্যাটিকান সিটি, কানাডা, ব্রাজিল, আলজেরিয়া, কসোভো, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিনিধি, আইআরআই এবং এনডিপির আবাসিক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।

ইফতার পূর্ব অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এ সন্ধ্যায় আমরা শুধু রমজানের ফজিলতই স্মরণ করছি না, বরং শান্তি, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির সেই অভিন্ন মূল্যবোধকেও স্মরণ করছি, যা সমগ্র মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।

দীর্ঘ ১১ বছর পর কুটনীতিকদের সম্মানে ইফতার আয়োজনে শুকরিয়া আদায় করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বিদেশি বন্ধুদের সম্মানে ইফতার আয়োজনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের এসব আয়োজন করতে দেয়নি। এমনকি কিছু অনুষ্ঠানের জন্য ভেন্যু বুকিং ও অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের বাধার কারণে আমাদের সেসব আয়োজন বাতিল করতে হয়েছে। আজ আমরা আবারও আপনাদের এই মর্যাদাপূর্ণ ইফতার মাহফিলে স্বাগত জানাচ্ছি।

অনুষ্ঠান থেকে জুলাই বিপ্লবের সব শহীদ ও নির্যাতিতদের স্মরণ করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, তাদের আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো মুক্ত হয়েছে।

জামায়াত আমির বলেন, আমরা এমন এক সময়ে একত্রিত হয়েছি, যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্য উপভোগ করছে। রমজান শুধু সিয়াম সাধনার মাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মনিবেদন করার মাস। রোজা রাখার মাধ্যমে আমরা নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কষ্ট অনুধাবন করি এবং আমাদের হৃদয়ে সহমর্মিতার বীজ বপন হয়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা শুধু শারীরিক অনুশীলন নয়; বরং এটি আত্মার পরিশুদ্ধি, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা এবং ন্যায়পরায়ণতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার নবায়ন করার মাধ্যম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় থাকে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ৯০-এর দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জামায়াত স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব দেয় ও এর পক্ষে জনমত তৈরি করে।

তবে গত ১৫ বছরের দুঃশাসনে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে দমন করার সব ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে উল্লেখ করে দলটির এ শীর্ষ নেতা বলেন, জামায়াতের পাঁচজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, ছয়জন নেতাকে কারাগারে বা পুলিশের হেফাজতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, অনেকে গুমের শিকার হয়েছেন এবং অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

এই নিষ্ঠুরতার মধ্যেও জামায়াত এবং এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির জুলাই বিপ্লবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংগঠনের নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যোগ করেন জামায়াত আমির।

বাংলাদেশ যেন আর কখনো পথ হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে দাবি করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জামায়াতে ইসলামী এ সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করেছে।

তিনি বলেন, বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর পক্ষে আমরা জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছি। আমরা বিশ্বাস করি এই ব্যবস্থা জনগণের মতামতকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করবে এবং ফ্যাসিবাদী শাসন পুনরায় ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করবে। এ ছাড়া লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবিও আমরা তুলে ধরেছি, কারণ তাদের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের এ আহ্বানে সাড়া দেবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

জামায়াত আমির বলেন, আমরা মনে করি, একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থা টেকসই শান্তি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দায়িত্ব হলো– প্রত্যেক নাগরিকের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং দেশ গঠনে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এ লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই– এ দেশের প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকারভুক্ত। ইসলাম আমাদের শেখায় যে বৈচিত্র্য এক আশীর্বাদ আর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমেই আমরা ন্যায়সংগত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে পারি।

তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের অংশগ্রহণ আমাদের বন্ধুত্ব ও সংলাপের প্রতি অঙ্গীকারের প্রমাণ। আসুন, আমরা এই উপলক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করি এবং এমন এক বিশ্ব গঠনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করি, যেখানে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইফতার অনুষ্ঠানে জামায়াতের অন্য নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, অ্যাডভোকেট মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, অ্যাড. এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, আবদুর রব ও অধ্যক্ষ মো. ইজ্জত উল্লাহ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাড. মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও অফিস সেক্রেটারি মাওলানা আফম আব্দুস সাত্তার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম প্রমুখ।