১০ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১০ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

‘নৈশভোটের’ সহযোগী এসপিরা পেয়েছেন দ্রুত পদোন্নতি


| PNN

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি) ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব কাছের। তাঁদের দাপটও ছিল বেশ। শুধু দাপটই নয়, পুরো পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ প্রায় সব কিছুতেই তাঁদের হাত থাকত। তাঁদের অনেকে পেয়েছেন দ্রুত পদোন্নতি। এসপি থেকে দুই-তিন বছরের মাথায় ডিআইজি পদে পদোন্নতি মিলেছে কারো কারো।

তাঁদের একজন সৈয়দ নুরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এমনকি প্রভাব খাটিয়ে দুই ভাইকেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় জনপ্রতিনিধি করারও সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন পলাতক বলে জানা গেছে।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি ‘রাতের ভোট’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। মূলত ‘রাতের ভোটের’ কারিগর হিসেবে ওই সময় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারদের দায়ী করা হয়ে থাকে। তাঁদের মধ্যে ঝালকাঠি জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জুবায়েদুর রহমান কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

গত শুক্রবার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আওয়ামী লীগের সময় ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের ৬৪ জেলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপারদের ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে।

এই স্ট্যাটাস দেওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এদিকে বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত) দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মধ্যে যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ অবস্থায় আসিফ ভূঁইয়ার এই স্ট্যাটাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সময় যাঁরা এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের প্রত্যেকে ২০১৮ সালের বিপিএম-পিপিএম পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম, পুলিশ সদর দপ্তরের সাবেক ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ বিপিএম পুরস্কার পান।

২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় সৈয়দ নুরুল ইসলাম কুমিল্লার এসপি ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি এসপি হিসেবে পদোন্নতি পান। এর পর তিনি নিজ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে তাঁর সমর্থিত একটি পক্ষ তৈরি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এক ভাইকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং অপর ভাইকে পৌর মেয়র বানান তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও প্রকাশ্যে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলতেন। সৈয়দ নুরুল ইসলাম ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি থাকাকালে পোশাক পরে বড় ভাই সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য সংসদ সদস্যের মনোনয়ন চাইতে গিয়েছিলেন। এ বিষয়েও তখন সমালোচনা হয়েছিল। মো. শহিদুল্লাহ ওই সময় ছিলেন রাজশাহীর এসপি। সম্প্রতি তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। ডিএমপির ডিবি এবং উত্তরা বিভাগের ডিসিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এই কর্মকর্তা।

নির্বাচনের সময় কক্সবাজারের এসপি ছিলেন এ বি এম মাসুদ হোসেন। তাঁর সময় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় তিনি ছিলেন ব্যাপক আলোচিত। পরে তাঁকে এসপি হিসেবে রাজশাহীতে বদলি করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুরস্কার হিসেবে তাঁকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিও দেওয়া হয়।

ওই এসপিদের আরেকজন ছিলেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় তিনি ঢাকা জেলার এসপি ছিলেন। বর্তমানে তিনি ডিআইজি হিসেবে রেলওয়ে পুলিশে সংযুক্ত আছেন।

৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত তিনি সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। ২০০১ সালে পুলিশে যোগ দিলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুরের এসপি হওয়ার পর থেকে তাঁর দ্রুত উন্নতি ঘটে।

২০তম ব্যাচের আরেক এসপি জিহাদুল কবির ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় চাঁদপুর জেলার এসপি ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১২ সালে পুলিশ সুপার হিসেবে মাগুরা জেলার দায়িত্ব পান। পরে রাজবাড়ী ও পাবনা জেলার এসপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাগেরহাট জেলার কাড়াপাড়া গ্রামের ছেলে জিহাদুল কবির ২০১৮ সালের পর দ্রুত অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকায় কর্মরত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন। এর আগে তিনি মেট্রো রেল (এমআরটি) পুলিশের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মোহাম্মদ নূরে আলম মিনা চট্টগ্রামের এসপি ছিলেন। পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হন। বর্তমানে তিনি পুলিশ একাডেমি সারদায় আছেন।

নূরে আলম মিনা ২০১২ সালে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পান। ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় এবং ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত সিলেট জেলার পুলিশ সুপার পদে ছিলেন। সাইফুল ইসলাম ছিলেন বরিশালের এসপি। পরে তিনিও ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান।

২০১৮ সালে কিশোরগঞ্জে এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাশরুকুর রহমান খালেদ। পরে তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজির দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাদারীপুরের তৎকালীন এসপি মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মোকতার হোসেন ছিলেন ভোলার এসপি। সেখানে কর্মরত থাকাকালে জড়িয়ে পড়েন নারী কেলেঙ্কারিতে। নারী কনস্টেবলের সঙ্গে তাঁর অনৈতিক সম্পর্কের একাধিক অডিও ভাইরাল হওয়ার পরও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান।

ইলিয়াছ শরীফ ছিলেন নোয়াখালীর এসপি। পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি হন। জাহাঙ্গীর আলম সরকার ওই সময় ছিলেন ফেনীর পুলিশ সুপার। মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায় তিনি ছিলেন ব্যাপক সমালোচিত।

একদশ নির্বাচনের সময় গাজীপুরের এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সামসুন্নাহার। এর আগে ওই জেলার এসপি ছিলেন ব্যাপক আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে। হারুনের বিরুদ্ধে বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ করার পর নির্বাচনের আগে তাঁকে সরিয়ে সেখানে এসপির দায়িত্ব দেওয়া হয় শামসুন্নাহারকে। ওই সময় সামসুন্নাহারের সৎ হিসেবে বেশ প্রশংসাও ছিল। কিন্তু নির্বাচনে তিনি সেই সততা দেখাতে পারেননি বলে এক পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন।

সিরাজগঞ্জের এসপি টুটুল চক্রবর্তী একসময় কুমিল্লার এসপি ছিলেন। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়লেও তাঁকে সরাতে সক্ষম হয়নি তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। তিনি কুমিল্লার এসপি হলেও পুলিশ বাহিনীতে প্রভাব বিস্তার করতেন বলে জানা গেছে। নির্বাচনের আগে তাঁকে সিরাজগঞ্জে বদলি করা হয়।