জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে
| PNN
৬ মার্চ, ২০২৫, ১:০৪ অপরাহ্ণ

বিগত আওয়ামী সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। যা মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো উদ্বেগের পাশাপাশি জরুরিভাবে ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। একইসঙ্গে এসব অপরাধ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনাগুলোর তদন্ত শেষে বুধবার (৫ মার্চ) জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। জেনেভায় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলসহ বাংলাদেশ সরকারের একাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিবার ও স্বজনদের পক্ষ থেকেও একাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে ওই সময়ের ঘটনাগুলো বর্ণনা করেন। পাশাপাশি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত যাত্রাবাড়ীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওপর একটি ভিডিও চিত্র দেখানো হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক উল্লেখ করেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয় থেকে বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রকৃত বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। যা ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহিতা, ক্ষতিপূরণ এবং এমন অবস্থান থেকে উত্তরণ ও সংস্কার কর্মসূচিকে সমর্থন করছে। যার মধ্যে ফৌজদারি মামলায় যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার তদন্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশের জন্য এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ হলো একটি বিস্তারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসময়ে সংঘটিত ভয়াবহ অন্যায়গুলোর সত্য উন্মোচন, নিরাময়, জবাবদিহিতার মুখোমুখি হওয়া, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতার প্রতিকার করা এবং এর পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনো না ঘটতে পারে তা নিশ্চিত করা। আমার কার্যালয় এ গুরুত্বপূর্ণ জবাবদিহিতা এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জেনেভায় জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস মিশনের প্রতিবেদনের প্রশংসা করে বাংলাদেশে গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আইনের আওতায় আনতে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেসব তুলে ধরেন। তিনি জানান, জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। জেনেভায় বুধবার মুগ্ধের ছোট ভাই স্নিগ্ধ উপস্থিত ছিলেন। স্নিগ্ধ বলেন, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার নিশ্চিত করতে না পারব ততক্ষণ ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাব।
জুলাই-আগস্টে আহত আরেকজন শিক্ষার্থীর বোন জেনেভায় বলেন, তার ভাইসহ যারা জুলাই-আগস্টে আহত হয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, তারা হাসপাতাল থেকে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাননি। কারণ ওই সময় সরকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসাসেবা দিতে মানা করেছিল।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমান করা হয় যে গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ আহত হন এবং এদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন। নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছে।
জুলাই-আগস্টের সহিংসতায় ৭৮ শতাংশ প্রাণহানি ঘটেছে গুলির ঘটনায়। যার মধ্যে ৬৬ শতাংশ গুলি মিলিটারি রাইফেলের, ১২ শতাংশ গুলি শটগানের, ২ শতাংশ গুলি পিস্তলের এবং ২০ শতাংশ অন্যান্য। দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার সঙ্গে জড়িত ছিল, এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল যেখানে মানুষকে বিন্দু-শূন্য পরিসীমা থেকে গুলি করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে দুই বাহু ছড়িয়ে ‘আমাকে গুলি করুন’ বলে চিৎকার করার সময়ের দৃশ্য ধারণ করা হয়। একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে তার আঘাতগুলো প্রায় ১৪ মিটার দূরত্ব থেকে ধাতব গুলি বোঝাই শটগান দিয়ে কমপক্ষে দুই বার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। আবু সাঈদ পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।