কৃষি পর্যটনের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে সিলেটের পতিত টিলা
Online Desk | PNN
১৭ জুলাই, ২০২৩, ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ
সিলেটের গোলাপগঞ্জে পতিত টিলায় আনারস আবাদ করে সুফল পাচ্ছেন বাগানমালিকেরা। আনারস ছাড়াও মাল্টা, কফি, কাজুবাদামের আবাদ হচ্ছে। পাশাপাশি গড়ে উঠছে কৃষি পর্যটন।
সারি সারি উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা। ভাঁজে ভাঁজে আনারস, কমলা, মাল্টা আর লেবুগাছ। আছে কাজুবাদাম আর কফিগাছও। টিকিট কেটে মানুষজন ফলবাগানে ঢুকছেন, ঘুরছেন, দেখছেন। টিলায় বসে অনেকেই কিনে খাচ্ছেন টাটকা আনারস আর লেবুর জুস। কেউ কেউ কিনে ব্যাগ ভরে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতেও। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল।
উপজেলার দত্তরাইল গ্রামে পাহাড়-টিলা ঘিরে কৃষি পর্যটন গড়ে উঠেছে। এসব টিলা আগে অনাবাদি ছিল। গত দুই বছরে দৃশ্যপট বদলে যায়। পতিত পাহাড়-টিলা ভরে গেছে আনারসের চারায়। এখন আনারস বিক্রি করেই কোনো কোনো চাষি বছরে কোটি টাকা আয় করছেন। এসব ফলবাগানের উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই প্রবাসী।
যেভাবে শুরু
দত্তরাইল গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান আবদুল মতিন চান মিয়ার আট ছেলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তাঁরাই প্রথম ২০১৮ সালে বাড়ির পাশের সাতটি টিলায় আনারস আবাদের উদ্যোগ নেন। আগে এসব টিলায় বেলজিয়াম ও আকাশিগাছ লাগানো হয়েছিল। সেগুলো কেটে সব টিলাকে ফল আবাদের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
প্রয়াত চেয়ারম্যানের ছেলেরা আনারসবাগানের নাম দেন ‘চান মিয়া পাইনআপেল গার্ডেন’। ৪০ একর জায়গায় বিস্তৃত বাগানে আড়াই লাখ আনারসগাছ আছে। মাল্টাগাছ আছে প্রায় ৪ হাজার। রয়েছে কলাগাছ ও লেবুগাছ। ২০২১ সালে স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় রোপণ করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার কফি ও কাজুবাদামগাছ। দর্শনার্থীদের জন্য একটি টিলার চূড়ায় বানানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও ওয়াকওয়ে। বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকছেন।
চান মিয়া পাইনআপেল গার্ডেন দেখভাল করেন চান মিয়ার নাতি কাউসার রাজা (৩৭)। তিনি জানান, বাগানের মূল উদ্যোক্তা তাঁর চাচা রাসেল আহমদ। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আনারসবাগান দেখে তিনি টিলায় আনারসবাগান করার উদ্যোগ নেন। তাঁর কথায় পরিবারের সবাই সম্মতি দেন। এই বাগান চালুর পর উপজেলায় আরও বাগান হয়েছে। তবে উপজেলায় এটিই সবচেয়ে বড় আনারসবাগান।
কাউসার রাজা বলেন, বাগান তৈরি করতে তাঁদের প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁদের সেই টাকা উঠে গেছে। তাঁরা চার দফায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রায় সোয়া কোটি টাকার আনারস বিক্রি করেছেন। এর বাইরে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার লেবু ও মাল্টা বিক্রি করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একটা সময় সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ‘জলঢুপি’ আনারসের সুখ্যাতি ছিল। এর বাইরে জেলার অন্যান্য উপজেলায় পাহাড়-টিলায় শৌখিনভাবে কিংবা পারিবারিক উদ্যোগে অল্প পরিসরে আনারস চাষ হতো। তবে বাণিজ্যিকভাবে বড় পরিসরে গোলাপগঞ্জে চান মিয়া পাইনআপেল গার্ডেন চালু হয়। এই উদ্যোগ সফল হওয়ায় ২০২১ সাল থেকে উপজেলায় একই ধরনের ৪০টি বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন আরও অনেকে বাগান চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন।
একাধিক বাগানের উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, স্থানীয় কৃষি বিভাগ বাগানমালিকদের পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে সহযোগিতা করছে। এমনকি আনারস ও মাল্টা ছাড়াও কৃষি বিভাগ টিলাগুলোর মাটি ও উৎপাদন ক্ষমতা পরীক্ষা করে এখানে কফি ও কাজুবাদাম গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছে। তাদের পরামর্শে প্রায় প্রতিটি বাগানেই কফি ও কাজুবাদামগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। কৃষি অধিদপ্তর বলছে, আগে কখনোই সিলেটে কফি ও কাজুবাদাম চাষ হয়নি।
সিলেটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ আনিছুজ্জামান বলেন, গোলাপগঞ্জের টিলাগুলোতে আগে অপরিকল্পিতভাবে মাটির উপযোগী-অনুপযোগী নানা গাছপালা লাগানো হতো। এখন কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। এতে কৃষকেরাও লাভবান হচ্ছেন। এখানকার উৎপাদিত আনারস সুমিষ্ট হওয়ায় বাজারেও এর আলাদা কদর রয়েছে।
আনিছুজ্জামান বলেন, সিলেটে চায়ের পর আর কোনো বিকল্প বাণিজ্যিক পণ্য পাহাড়-টিলায় উৎপাদন করা হয়নি। আনারস, কমলা, মাল্টা, লেবু, কফি ও কাজুবাদাম চাষের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক ফলনের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। গোলাপগঞ্জের এক বাগানমালিক তাঁর বাগানে উৎপাদিত কফি প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রির জন্য একটি কারখানা স্থাপনেরও উদ্যোগ নিয়েছেন। মূলত টিলায় চাষাবাদ শুরু হওয়ায় সিলেটে কৃষিক্ষেত্রে নতুন এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, গোলাপগঞ্জে সফল হওয়ায় জেলার বিয়ানীবাজার, জৈন্তাপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট সদরসহ অন্যান্য উপজেলার অনাবাদি টিলাও চাষাবাদের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। এসব টিলায় আনারস, লেবু, কমলা, মাল্টা, কফি, কাজুবাদাম চাষের পাশাপাশি কাঁঠাল, লিচু, লটকন, আম, বেল, জামসহ বিভিন্ন জাতের ফলের আবাদ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সৌজন্যে: প্রথম আলো