কী করলে নতুন দল সারাদেশে জনসম্পৃক্ততা পেতে পারে, কিংবা বড় দল হয়ে উঠতে পারে?
আজহার লিমন, সংবাদকর্মী | PNN
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২:২২ অপরাহ্ণ

কী করলে নতুন দল সারাদেশে জনসম্পৃক্ততা পেতে পারে, কিংবা বড় দল হয়ে উঠতে পারে?
এবিষয়ে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নিজ ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট করেছেন এখন টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আজহার লিমন। নিচে বিষয়গুলো হুবহু তুলে ধরা হল:
এক.
আপনি আ’লীগ-বিএনপির সারাদেশে গণভিত্তি পাওয়াটাকে খেয়াল করতে পারেন। খেয়াল করেন, শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন ভাসানীকে ছাপিয়ে। কীভাবে তার দল ভাসানীর ন্যাপের চেয়ে জনপ্রিয়ই থেকে গেলো।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং সারাদেশে চরকির মতো ঘুরে-বেড়িয়েছেন, জনসভা করেছেন গ্রামে-গঞ্জে। ফলে পুরো লিডারশীপ তার কন্ট্রোলে চলে এসেছিলো এবং জনগনও তাকে আলাদাভাবে চিনতে পেরেছে। তিনি ও তার দল অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছেন সেই সময়ে।
পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান কী করেছেন? সেই গল্প নিশ্চয়ই মনে আছে। বর্ষীয়ান পরামর্শকরা তাকে গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে হেঁটে হেঁটে মানুষের কাছে যেতে বলেছেন। জিয়াউর রহমান সেটা করেছেনও।
তিনি খাল-খনন করতে গ্রামে গেছেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে মোটামুটি পুরো দেশ ঘুরেছেন। মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। গ্রামে এগুলো অনেক ম্যাটার করে। এত বড় একজন নেতা একটা গ্রামে যাবেন, আশেপাশের সবগ্রামে তার গল্প ছড়িয়ে পড়বে, মানুষ তাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মনে রাখবে, তার গল্প করবে। জিয়ারউর রহমানের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। এটা প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও তার ফ্যানবেইজ এবং দলের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে।
নতুন দলের নেতাদেরও কি গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাড়া ফেলার মতো নেতা আছে? আছে।
দেখেন, এই দলে নাহিদ, আখতার, আসিফ মাহমুদ, সারজিস, হাসনাত, সামান্তা এবং মাহফুজ আব্দুল্লাহ -এরকম আটজন বড় ফিগার রয়েছে। তাদের মধ্যে কারও কারও ইর্ষণীয় পরিচিত আছে সারাদেশে। নাহিদ, হাসনাত, সারজিস তার অন্যতম। এছাড়া আসিফ, আখতার অন্তত: নিজ নিজ বিভাগে ভালো অপশন। সুতরাং শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমানের পথ ধরে এই নেতাদের আটটি বিভাগে টানা দুই/তিন মাস ছুটতে হবে। কথা কম, হাঁটা বেশি, পথসভা বেশি।
দেখেন, বাংলাদেশের মানুষ আবেগপ্রবণ। দলের ভিত্তি তৈরি করতে হলে ফিজিক্যালি তাদের কাছে যাওয়া জরুরি। প্রতিটা উপজেলার প্রতিটা গ্রামে অন্তত: একবার হলেও পদধূলি দিতে হবে, গ্রামের মানুষের হাতে টাচ করতে হবে, মাটির শানকিতে ভাত খেতে হবে কৃষকের সঙ্গে। মাও সেতুংয়ের ভাষ্য অনুযায়ী যখন দলের কর্মসূচি কী হবে, কৌশল কী হবে -সেটা বুঝতে পারছেন না, তখন আসলে আপনার গ্রামে যাওয়া উচিত। সুতরাং শহর, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দাপিয়ে বেড়ালে স্টারডম হবে, দল গড়ে উঠবে না। গ্রাম, গ্রাম এবং গ্রাম -এটাই বেসিক। এমনকি এরশাদও ৬৮ হাজার গ্রামের কথা বলেছেন, গ্রামমুখী হয়েছিলেন, তার উপাধিও ছিলো পল্লীবন্ধু।
এছাড়া স্কুল-কলেজে যেতে হবে। লাখ লাখ স্কুল পড়ুয়া ভবিষ্যতের ভোটার, তাদের কাছে হাসনাত-সারজিসরা স্টার। সুতরাং তারা গেলে সাড়া পড়বে এটা নিশ্চিত। একে ক্যাশ করার উপায় তারা বের করতে পারেন। পাকিস্তানের ইমরান খানকে প্রতিষ্ঠিত ভোটাররা ভোট দেয়নি। ইমরান খানের শিশু-তরুণ ভক্তরাই পরে ভোটার হয়ে তার ভ্যানগার্ড হয়েছেন।
দুই.
নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠী উদ্ভবের পরিবেশ সৃষ্টি করা। এটার জন্য অবশ্য ক্ষমতায় থাকা জরুরি। কিন্তু ছাত্রপ্রভাবিত অন্তবর্তীকালীন সরকারও সে কাজটা শুরু করে দিতে পারে।
কারণ এটা স্পষ্ট যে, দেশ এবং রাজনীতি শুধু পলিটিক্যাল দল চালায় না। এখানে নাগরিক সমাজ আছে, ব্যবসায়ী আছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, এজেন্সি আছে, গণমাধ্যম আছে, মানবাধিকার কর্মী আছে। এরকম বহু স্টেকহোল্ডার আছে। এরমধ্যে বিশেষভাবে নাগরিক, ব্যবসায়ী এবং প্রশাসনে সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করা জরুরি। বিশেষকরে নাগরিক এবং ব্যবসায়ী সমাজে। কারণ এরাই রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
এরজন্য দরকার নতুন একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করা। সেখান থেকেই নতুন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তৈরি হবে। এখনকার অলিগার্ক ভেঙ্গে যাবে অথবা ভাঙতে হবে।
এরজন্য কী করবেন? খুব সাধারণ। এটার জন্য একটা মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আপনি কাউকে উঠিয়ে আনবেন না, ব্যবসা ধরায় দিবেন না। জাস্ট পরিবেশ ও প্রক্রিয়া সহজ করবেন, নতুন ব্যবসায়ীদের লোনের ব্যবস্থা করবেন, মানুষ এমনিতেই উঠে আসবে। প্রতিটি চাকরি ফ্রি, ফেয়ার করবেন, তারা আপনার মৌন সমর্থক হয়ে থাকবে। তুরস্কের এরদোয়ান এই পদ্ধতির বড় বেনেফিশিয়ারি। তার সময়ে গজিয়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত শেণি এবং মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীই হচ্ছে তার শক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
তিন.
ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এরকম যে কোনও একটা বা দুটি সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে জয়ী হওয়া জরুরি। জিততে পারলে সেখানে দলের রাষ্ট্রপরিচালনার একটা সম্ভাব্য প্রমো দেখানো যায়। বিশ্বে অনেক বড় বড় নেতা এভাবে তৈরি হয়েছে। এরদোয়ান আগে মেয়র হয়ে সুশাসনের নজীর গড়েছেন, পরে সেটাকে সেল করেছেন। নরেন্দ্র মোদী গুজরাটে আগে সফলতা দেখিয়েছেন। সুতরাং নতুন দলের নেতারাও নির্দিষ্ট ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের মতো কোনও একটি মেয়রের পদকে পাখির চোখ করতে পারেন।
চার.
প্রচলিত রাজনীতি, রাজনীতির ভাষা, স্টাইল নিয়ে যে পরিবর্তন মানুষ চায়, সেটার স্কোপ তৈরি করা। সে ধরণের ভাষা-আদর্শ-কর্মসূচি নির্মাণ করা।
পাঁচ.
দেশ ও গণমানুষের পক্ষে সৎ, প্রতিবাদী এবং সাহসী ভূমিকা রাখা। নুরুল হক নুর সেটা করেছেন। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তার সময়কার সহযোদ্ধা তরুণরা তাকে ছেড়ে যায়নি, নতুন করে সমর্থকগোষ্ঠীও তৈরি করতে পেরেছে তার দল। নতুন দল একবারে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাকে প্রথম দিকে হয়তো বিরোধী দলে থাকতে হবে। সেই সময়ে কার্যকর বিরোধীতা, ঐক্য এবং সততা দেখাতে হবে।