২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

ই-সিগারেট নিয়ে টিসিআরসির আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত


| PNN

২৪ জুন, ২০২৩, ৫:৩৮ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বাজার ও ব্যবহার ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। তামাক কোম্পানীগুলোর বিভিন্ন অপপ্রচার ও কৌশলী ভূমিকার কারণে অনেক তরুণ-তরুণী জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর নতুন এই তামাক পণ্যের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। ফলে টিন, নিকেল, ক্যাডিয়াম, লেড, মার্কারিসহ বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান সম্বলিত ই-সিগারেট বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে দেশে ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোকসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে ভয়াবহভাবে।

তামাকবিরোধী কর্মী, তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমতবস্থায় যথাযথ আইনের অনুপস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাবে ই-সিগারেট দেশের তরুণ-তরুণীদের জন্য সর্বনাশা হয়ে উঠছে। রাজধানীর বনানীর প্লাটিনাম গ্রান্ড হোটেলে আয়োজিত ‘‘ই-সিগারেটের আসক্তি ও স্বাস্থ্যক্ষতি: জনস্বাস্থ্য রক্ষায় উপায়’’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি), ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্ক-আইপিএন এবং ইনিশিয়েটিভ ফর পাবলিক হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড কমিউনিকেশন (আইপিএইচআরসি) এর যৌথ আয়োজনে শনিবার (২৪ জুন, ২০২৩) এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে টিসিআরসির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারহানা জামান লিজা বলেন, বাংলাদেশে ই-সিগারেট ব্যাপক আকারে বিস্তৃত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর ই-সিগারেটের লাগাম টেনে ধরার জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিদ্যমান বিভিন্ন আইন ও বিধি-বিধানের মাধ্যমে ই-সিগারেটের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। এছাড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার জে¦ার দাবি জানান এই তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক।

আলোচনায় প্যানেল আলোচক ও অন্যান্য বক্তারা ফারহানা জামান লিজার বক্তব্য ও দাবিকে সমর্থন করে বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের লাগাম ধরে রাখার এখনই সময়; আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেটের উৎপাদন, আমদানি, ব্যবহার, বিক্রয় ও বিপণন নিষিদ্ধ করতে হবে।

টিসিআরসির সভাপতি ব্যরিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপির সভাপতিত্বে এবং টিসিআরসির সদস্য সচিব ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগি অধ্যাপক মোঃ বজলুর রহমানের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ট্যোবাকো পলিসি নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ড. রোমানা হক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইসেন্স এর পাবলিক হেলথ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসাইন, একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি এবং আইপিএইচআরসির নির্বাহী পরিচালক সুশান্ত সিনহা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক ও আইপিএন এর নির্বাহী পরিচালক এহসানুল হক জসীম। অনুষ্ঠানে আরো অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইসেন্স এর শিক্ষক পলাশ চন্দ্র ভৌমিক, আইপিএনের পরিচালক কেফায়েতুল্লাহ চৌধুরী শাকিল, নাটাবের খলিল উল্লাহ, সিএলপিএ ট্রাস্টের কামরুন্নিসা মুন্না প্রমুখ।

সভাপতির বক্তব্যে ব্যরিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি বলেন, বাংলাদেশের ১৫৩ জন এমপি ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন। ই-সিগারেট বন্ধে এখনই কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি। ই-সিগারেটের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য তিনি উদাত্ত আহ্বান জানান। ই-সিগারেটের ভয়াবহতা তুলে ধরে এই সংসদ সদস্য বলেন, “আইন প্রণনয়ন বা সংশোধনের জন্য অপেক্ষা না করে নির্বাহী আদেশে এখনই ই-সিগারেটে নিষিদ্ধ করতে হবে।”

অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দীন ফারুক তাঁর বক্তব্যে ই-সিগারেটের নানা ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বলেন, এর বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। ই-সিগারেটের ব্যবহার ও বাজার সম্প্রসারণের জন্য ভ্যািিপং উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা খুবই দুঃখজনক। আমাদের উচিত, নোন-স্মোকারদের নিয়ে মেলা বা উৎসব আয়োজন করা।

অধ্যাপক ড. রোমানা হক বলেন, হার্ম রিডাকশন বা কম ক্ষতিকর টার্ম ব্যবহার তামাক কোম্পানীগুলো তরুণ-যুবক এবং ধূমপায়ীদের ই-সিগারেটের আকৃষ্ট করছে। ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর নয়, বরং খুবই ক্ষতিকর একটি পণ্য।

অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসাইন বলেন, ই-সিগারেট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ই-সিগারেটের কারণে ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোকসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে ভয়াবহভাবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে খুবই নিরবে ই-সিগারেটের বাজার ব্যাপক আকারে সম্প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু ই-সিগারেট নিয়ে আমাদের গবেষণা খুবই কম হচ্ছে। তিনি ই-সিগারেট ইস্যুতে গবেষণা বাড়ানোর তাগিদ দেন।

মোঃ বজলুর রহমান বলেন, ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য ব্যাহত করতে তামাক কোম্পানীগুলো তরুণদের আসক্ত করতে বিভিন্ন কূটকৌশল প্রয়োগ করে দেশে ই-সিগারেটের বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ করছে। ঢাকা ইন্টারন্যাশলাল ইউনিভার্সিটি ই-সিগারেট বন্ধে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

এহসানুল হক জসীম বলেন, ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্ক-আইপিএন এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণার উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ই-সিগারেট আগমনের পর প্রথম ৪/৫ বছর পর্যন্ত কেবলই রাজধানীর কিছু অভিজাত এলাকায় ই-সিগারেটের অল্প কিছু দোকান ছিল। ই-স্মোকারের সংখ্যাও তখন খুবই কম ছিল। এখন সারাদেশে ই-সিগারেট পাওয়া যায়। জ্যামিতিক হারে আশংকাজনকভাবে বাড়ছে ই-স্মোকারের সংখ্যা, ই-সিগারেটের ব্যবহার।  সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে চালু হয়েছে এবং এখনো ই-সিগারেট বিক্রি করছে, এমন দোকানের সংখ্যা ২২%। বাকি ৭৮% ই-সিগারেেেটর দোকান ২০১৬ সালের পর (২০১৭-২০২১) পাঁচ বছরের মধ্যে চালু হয়।

সুশান্ত সিনহা তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্রচলিত সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপানে যে ক্ষতি হয়, তার চাইতে ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর বলে প্রতারণামূলক তথ্য পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ই-সিগারেটের বাজার বিস্তৃত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কখনো ধূমপান করেনি এমন তরুণ-যুবকদেরও ই-সিগারেটের প্রতি অভ্যস্ত করতে তামাক কোম্পানীগুলো এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে, অনেকে এখনই যুগপৎভাবে ধূমপান করছে এবং ভ্যাপও ব্যবহার করছে। জনস্বাস্থ্যের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ই-সিগারেট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এখনই নেওয়ার কোন বিকল্প নেই।

ফারহানা জামান লিজা তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, তামাক কোম্পানীগুলোর বিভিন্ন কূটকৌশলের কারণে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের ব্যবহার ও নতুন এই তামাক পণ্যের বাজার জ্যামিতিক হারে বিস্তৃত হচ্ছে। ই-সিগারেটের প্রসারের জন্য নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ এবং ওটিটি প্লাটফর্মের মাধ্যমেও কৌশলী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে ই-সিগারেটের প্রচারণায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

টিসিআরসির গবেষণার উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ই-সিগারেট গ্রাহকদের বেশিরভাগই যুবক, বিশেষ করে ছাত্র। তথাকথিত ইতিবাচক তুলে ধরে তরুণদের ই-সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ই-সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করতে কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের আশেপাশে ই-সিগারেটের দোকান চালু করে ই-সিগারেট বিক্রয় করা হচ্ছে।